আজ তাঁর জন্মদিন। হারাতে বসা এক শিল্পকে শুধু জাগিয়েই তোলেননি, স্পিন বোলিংও যে গ্ল্যামারের অংশ হতে পারে, সেটা দেখিয়েছিলেন আবদুল কাদির। পাকিস্তানি এই কিংবদন্তির প্রয়াণও সেপ্টেম্বরেই; জন্মদিনের নয় দিন আগে, ৬ সেপ্টেম্বর। ‘পুবের জাদুকর’ হিসেবে খ্যাত কাদিরের ৭০তম জন্মদিনে তাঁকে নিয়ে লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
সব জাদুরই তিনটি পর্যায় থাকে। প্রতিজ্ঞা, রূপান্তর ও মর্যাদা। শুরুতে জাদুকর খুব সাধারণ কিছু দেখান। কবুতর, কার্ড কিংবা বল। চোখের সামনে থাকে। আর জাদুকর রহস্য করে বুঝিয়ে দেন, কিছু একটা হতে চলেছে। এটুকু প্রতিজ্ঞা।
এরপর জাদুকর তা পাল্টে দেন বা উধাও করে দেন। এটুকু রূপান্তর। কঠিন কাজটুকু সবশেষে। ফিরিয়ে আনা মানে আগে যা ছিল। তা করতে পারলেই জাদুকর মর্যাদাবান। যেমনটা করেন একজন লেগ স্পিনার, একজন শেন ওয়ার্ন কিংবা আবদুল কাদির।
বাইশ গজে সেই মন্ত্রপুত বলের রূপান্তর ঘটে শেষ মোচড়ে, না হলে আঙুলের ভেলকি। বাকিটা ব্যাটসম্যান ও দর্শকের জন্য। কেউ বোকামি করে দুখী, কেউ বোকা বনে সুখী, রোমাঞ্চিত। এটা কী হলো! উত্তেজিত ধারাভাষ্যকার ধরিয়ে দেন, গুগলি!
আসলে চাতুরী। জাদুকরদের মতো আরকি। চোখে দেখেও ভাবতে হয়, কীভাবে সম্ভব! কাদির এ ভাবনা নিয়ে খেলেছেন প্রতি ম্যাচেই। বড় বড় বাঁকের ওপর দুরকম গুগলি, ইচ্ছেমতো ফিরিয়ে এনে—দর্শকেরা ভেবেছে, সাধু! সাধু!
সাধকই সাধকের পথ করে দেয়। দানিশ কানেরিয়াকে কাদির বলতেন, ‘মাই প্রোডাক্ট।’ দুজনের অ্যাকশন কার্বন কপি না হলেও কাছাকাছি। বাঁকটাও জোরের ওপর। ইমরান তাহির কিংবা মুশতাক আহমেদ—তাঁদের অ্যাকশন-কলার ভিত কাদির। তাঁর কাছে স্টুয়ার্ট ম্যাকগিলকে নিয়ে গিয়েছিলেন স্টিভ ওয়াহ। পল স্ট্রাংকে শেখানোর অনুরোধ করেছিলেন এন্ডি ফ্লাওয়ার। ১৯৯৪ সালে পাকিস্তান সফরে তাঁর বাসায় গিয়ে গুগলির তালিম নিয়ে এসেছিলেন শেন ওয়ার্ন। রাতে আপেল দিয়ে কসরত করে ওয়ার্ন উইকেটও তুলে নেন পরদিন টেস্টে। তারপর ফোন করে কাদিরকে বলেছিলেন—‘ডিড ইউ সি দ্যাট?’

পাকিস্তানের এক টিভি চ্যানেলে সে কথা বলতে গিয়ে আরেকটি ঘটনাও বলেছিলেন কাদির, তাঁর বাসায় গিয়ে ওয়ার্নের সিগারেট ফোঁকার ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু ওয়ার্ন তা করেননি, ওটা যে কাদিরের বাসা তাই। সেই কাদির, যার বোলিংয়ের গাদা গাদা ভিডিও থাকত ওয়ার্নের দেরাজে। এমন গল্পও প্রচলিত আছে সেবার কাদিরের বাসায় গিয়ে দুই কিংবদন্তি কমলা দিয়ে গালিচার ওপর লেগ স্পিন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। যদি নতুন কোনো ভেলকি বের করা যায়! আসলে আশির দশকের কাদিরকে দেখেই নিজেকে গড়ার প্রেরণা পেয়েছিলেন ওয়ার্ন। আর কাদির? তাঁকে বর্ণনা করতে জাদুকরদের প্রসঙ্গে ফিরতেই হচ্ছে।
জাদুতে কৌশলটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ঝুলিতে যত বেশি কৌশল তিনি তত ভালো। এ জন্য অনুশীলন করতে হয় দিনের পর দিন। লেগ স্পিনও তাই। ভেলকির প্রাচুর্য থাকতে হয়। আর তা করতে গিয়ে কাদিরের দর্শন ছিল জাদুকরদের মতোই, ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বোলিং করে বাড়ি ফেরার সময়ও তার ঝুলিতে কিছু ভেলকি থেকে যাওয়া উচিত। সে একজন লেগ স্পিনার। কোনো কিছু অবশিষ্ট না থাকলে লেগ স্পিনার না।
মানেটা হলো বৈচিত্র্য—কাদিরের স্পিন শব্দটার ধারক। তবে শুরুটা এমন ছিল না। ১৯৫৫ সালে লাহোরে খুব সাধারণ ঘরে জন্ম নেওয়া কাদির শৈশবে রাস্তাঘাটে খেলাধুলায় মত্ত থাকতেন। সেটি হকি থেকে মার্বেল কিংবা ক্রিকেট। একদিন রাস্তায় মার্বেল খেলার সময় এক বন্ধুর অনুরোধ ফেলতে না পেরে যোগ দেন ক্রিকেট খেলায়। কাদিরের ভাষায়, সবচেয়ে বাজে খেলোয়াড়কে ওরা ওপেন করতে পাঠাত। প্রথম বলেই বোল্ড হই। বলা হলো, যেও না, ওটা ট্রাই বলছিল। পরের বলে আবারও বোল্ড।

শুরু থেকেই ব্যাট তাঁকে অতটা টানেনি যতটা ‘রেড চেরি’ লাল বলটা। শিয়রে বল রেখে ঘুমোনোর অভ্যাস ছিল। বলের যত ছলচাতুরী আবিষ্কার করতেন অনুশীলনে। সেসব মাঠে ফলানো গল্পগাথা হয়ে আছে।
কাদিরের বিশ্বাস ছিল, যে উইকেটে কোনো কিছুতেই কাজ হয় না সেখানে লেগ স্পিন সফল হবে। এটাই এ ঘরানার সৌন্দর্য। যেখানে বলে বাঁক নেই, সেখানে লেগ স্পিন পেতে পারে। এনে দিতে পারে অবিশ্বাস্য সব বৈচিত্র্য। আর এ ঘরানায় বৈচিত্র্যে কাদির যেন বিশ্বকোষ! তাঁর নিজের কথা, ‘এক বল (ডেলিভারি) দশভাবে করতে পারি। দশ লেগব্রেক, দশ গুগলি ও দশ ফ্লিপার।’ যোগ করুন গতি বৈচিত্র্য ও অ্যাঙ্গেল মানে উইকেটে কোণের ব্যবহার।
অ্যাঙ্গেলে ঝোঁক ছিল। স্টাম্পের কাছ থেকে বল করলে বেশি বাঁক, দূর থেকে করলে তুলনামূলক কম। ক্রিজের পেছন থেকে বল করলে ফ্লাইট বেশি। দৌড়ে আসার অ্যাঙ্গেল, কখনো ৪৫ ডিগ্রি কোণে কখনো তার বেশি কিংবা কম, এতেও সেই বলের বাঁকের তারতম্য। এক ডেলিভারিতেই কয়েকটি আঙুলের ব্যবহার ছিল। গতি বৈচিত্র্য আর বাঁকের তারতম্যের জন্য।
ওয়ার্ন বল গ্রিপ করেছেন পাঁচ আঙুলেই। বল ধরায় ‘কমফোর্ট ফিলিং’ প্রাধান্য পেত। কাদিরের সাধারণ গ্রিপ ছিল, মধ্যমা, অনামিকা ও কনিষ্ঠা আঙুল একসঙ্গে মাঝে ফাঁক রেখে ওপাশে তর্জনী। মধ্যমা পেছনে থাকায় বল ছাড়ায় জোর পেত। আর ছিল দুরকম গুগলি।
জাদুকর বলেই ইংরেজরা ডেকেছে ‘উইজার্ড অব ইস্ট’। ইমরান খানের পরামর্শে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি রেখে সেবার (১৯৮২) ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন। দাড়িতে বেশ রহস্যময়, জাদুকর জাদুকর একটা ভাব আসবে। কাজ হয়েছিল ভালোই। চন্দ্রশেখরের পর প্রায় হারিয়ে যেতে বসা চাতুরী (গুগলি) ফেরার স্থায়ী ভিত পেয়ে যায়।
কাদিরের সঙ্গে সেই সাক্ষাতের পর তাঁকে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন ওয়ার্ন, ‘সেরার প্রতি। ধন্যবাদ সবকিছুর জন্য। আবার দেখা হবে।’
ঠিকানা এখন একই হওয়ায় নিশ্চয়ই দেখা হয়েছে তাঁদের। কাদিরের সঙ্গে আজ হাতটা মিলিয়ে ওয়ার্ন নিশ্চয়ই বলেছেন, ‘শুভ জন্মদিন’।
Hi, this is a comment.
To get started with moderating, editing, and deleting comments, please visit the Comments screen in the dashboard.
Commenter avatars come from Gravatar.